রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূগোল-বিজ্ঞান চর্চা

আজ ২৫ শে বৈশাখ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। এই মহামানব ভূগোল ও বিজ্ঞান চর্চাতেও পিছিয়ে থাকেননি। আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী তে কবিগুরুর স্মরণে এই বিশেষ নিবন্ধটি প্রকাশিত হল।

চিত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Picture Credit: Hindustan Times)

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেম সৌন্দর্য্যের অপরূপ স্রষ্টা হলেও তিনি প্রবলভাবে বিজ্ঞানমনষ্ক। রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবনকর্মই মানুষের কল্যান সাধনের অভিপ্রায়ে ধাবিত। তবে এই কবি কিভাবে এবং কোন ভাবনায় নিজের চেতনায় বিজ্ঞানের ভিত গড়েছিলেন, সেটা বুঝতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে তার শৈশব জীবনের দিকে। জীবন সাধক রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না’।

চিত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) জীবনকাল উনিশ – বিশ শতকে সমভাবে বিস্তৃত ছিল। উনিশের শেষ ভাগে এবং বিশ শতকের প্রথমভাগে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেই ইউরোপে শিল্প বিল্পব ঘটে যায়। স্টিম ইঞ্জিন ব্যাপকভাবে চালু হলে পৃথিবীর দূরত্ব ঘুচতে শুরু করে, সভ্যতার বিকাশ দ্রুততর হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ঠিক আগেই ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ জীববিদ্যার ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে বসে। প্রায় একই সময়ে রসানবিদ্যায় নানা আবিষ্কার, বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, জীবাণুতত্ত্বসহ নানা উদ্ভাবনা মানুষের জীবন যাত্রায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটাতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ জন্ম গ্রহণ করার পরই শৈশবেই সকল নব উদ্ভাবনা কথা জানতে পারলেন।

আমরা তো জানিই যে শিশু রবীন্দ্রনাথ সাধারন স্কুলের মনোযোগী ছাত্র না হয়ে ওঠতে পারলেও ঠাকুরবাড়ীর পাঠশালায় গৃহশিক্ষকদের রুটিন পাঠের হাত থেকে নিস্তার ছিলনা তাঁর। গণিত, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যায় পাঠ নিতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের। আর সাহিত্যে পাঠ নিতে হতো মেঘনাদবধকাব্য থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে আমাদের জানিয়েছেন যে, কঙ্কাল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানব দেহের খুটিনাটি শেখাতেন এক পন্ডিত। আর মানব দেহের বৈজ্ঞানিক পাঠ নিতে মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে লাশকাটার আদ্যোপান্তও দেখতে যেতে হত ঠাকুরবাড়ীর কিশোর বালকদের। অল্প বয়সে বিজ্ঞানের এসব চর্চায় রবীন্দ্রনাথের কিশোর মন বিরূপ হয়ে ওঠেনি বরং সে সবে বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহের যোগ হয়েছিল তা আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের কথা থেকেই। কবি জানাচ্ছেন, সপ্তাহে একদিন রবিবার ‘সীতানাথ দত্ত (ঘোষ) মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্র যোগে প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন।.. যে রবিবার সকালে তিনি না আসিতেন, সে রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।’’ (জীবনস্মৃতি,পৃ-৪১)

চিত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধী একসাথে কথাবার্তা বলছেন

আমরা আরও জানতে পারি পিতার সাথে যখন ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন সেটা নিছক পাহাড় দর্শন পর্ব থাকত না ; পাহাড়ে বেড়ানোর প্রতিটি সন্ধ্যা অবলীলায় জ্যোতির্বিদ্যার প্র্যাক্টিক্যাল সেশন হয়ে ওঠতো। জ্যোতির্বিদ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্রকে পাহাড়োর চূড়া থেকে সন্ধ্যাবেলায় দূরবীক্ষণ যন্ত্রযোগে নক্ষত্রমন্ডলীর গ্রহ নক্ষত্রদের চিনিয়ে দিতেন। জ্যোতির্বিদ্যার পাশাপাশি পিতার কাছ থেকে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারগুলোর বিষয়েও পাঠ নিতেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। পিতার কাছ থেকে পাওয়া ধারনা নিয়েই তিনি লিখেছিলেন প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ (১৮৭৩) বার বছর বয়সে। এই লেখাই পরিবারে বিজ্ঞানের লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ঠাকুর বাড়ি থেকে শিশু কিশোরদের জন্য ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। রবীন্দ্রনাথকে সে পত্রিকায় পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে শিশু কিশোর উপযোগী লেখা দেবার জন্য নিয়মিত লেখক হিসাবে মনোনীত হন। ‘বালক’ পত্রিকায় বালক কবি প্রায় প্রতি সংখ্যায় লিখেছেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাধনা’ নামে পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ সাধনায় প্রাণীবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে অনেকগুলো লেখা দিয়েছিলেন। নতুন ইংরেজি শিক্ষিতজন তখন বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় কিছু কিছু লিখতে শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সেসব রচনা পড়েও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিছুকালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের জোতির্বিজ্ঞানের আগ্রহ প্রাণবিজ্ঞানে সঞ্চারিত হয়েছিল।

চিত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী

বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ক এক প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্রকে চমকে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহবশেই তিনি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের সাহচার্য পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’-এ রবীন্দ্রনাথ ‘জড় কি সজীব?’ — এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যেটি ১৯০১ ছাপা হয়েছিল। সেটি পড়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিস্মিত হয়েছিলেন আর তিনি তার সেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে ,‘তুমি যদি কবি না হইতে তো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হতে পারিতে।’

চিত্রঃ আইস্টাইন এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হতে চাননি বটে কিন্তু আজীবন বিজ্ঞান চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানের লোকহিত প্রায়োগিক দিকটি মাথায় রেখেই। তিনি যর্থাথই মনে করতেন বিজ্ঞানের হাত ধরেই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতি তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখতেন। তিনি যখন ১৯২৬ ইউরোপের পথে বেরোলেন, জার্মানীতে গেলেন আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে। আইনস্টাইন তখন তাঁর আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব প্রকাশ করে বিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন তুললেন। সেখানে আইনস্টাইনের কাছে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা জানতে পারলেন। ফিরে এসে তিনি অনুজ সত্যেন বোসকে খুজে বের করলেন এবং তার সাথে বিজ্ঞান চর্চায় যুক্ত হন। ৪ বছর পর ১৯৩০ এ আবার তিনি জার্মানিতে যান আইনস্টাইনের সাথে দেখা করেন। এ সময়ই বেতারযন্ত্র, আকাশ বিজয়, তেজস্ক্রিয়া, পরমাণুর গড়ন, ইলেকট্রন-প্রোটন, দুধরণের তড়িৎকণা, কোয়ান্টামবাদ, জ্যোতিষ্ক লোকের রহস্য, জীবাণুতত্ত্ব, বংশগতিবিদ্যা – এসব বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনা রবীন্দ্রনাথের মনেও প্রবলভাবে দোলা দিয়েছিল।

Image: Visva-Bharati University was started in 1921 at Santiniketan. (Shutterstock)

রবীন্দ্রনাথ যর্থাথই বুঝেছিলেন অন্ধ বিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা জাগাতে বিজ্ঞানের চেতনার বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানবোধের অভাবটি বুঝতে পারেন না কিন্তু এ নিদারূণ এক দৈন্য। এই দৈন্য কাজের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে রেখেছে। এই দৈন্য মানুষকে নিরীহ করে রেখেছে যা তাকে নানা নির্যাতন ভোগে বাধ্য করে রাখে।

Image: Rabindranath Tagore is the first non-European to win the Nobel Prize for Literature (Credit: Hindustan Times)

রবীন্দ্রনাথ তারা গোটা জীবনের বিজ্ঞান ভাবনাকে পরিণত বয়সে এসে গ্রন্থিত করার কথা ভাবেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তিনি ১৯৩৭ এ ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে যে প্রবন্ধ সংকলনটি প্রকাশ করেন সেটি মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। আজকের অধুনা বিশ্ব মানেই বিজ্ঞান সৃষ্ট সভ্যতা। সে নিরিখেই সম্ভবত কিশোর রবির চিত্তে এমন প্রণোদনা। ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের প্রবন্ধের সূচিটি দেখলেই হতবাক হতে হয়। পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক — সহজ বাংলায় বিজ্ঞানের অমন কঠিন বিষয়গুলো পরিচিতি দিয়েছেন ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের গ্রন্থে। রবীন্দ্র অনুধ্যানে আরো বিস্ময়জাগে যে, জীবনের শেষ পর্বে কবি নাকি বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ আর নবপ্রাকৃত তত্ত্বে অভিভূত ছিলেন।

চিত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী

লেখকঃ অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (সহযোগী সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া, পার্শ্বলা, বাঁকুড়া) ।
তথ্যসূত্রঃ- সাহিত্য বাজার।

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত